হজ্বের পটভূমিকা
হজ্বের পটভূমিকা
যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ মুসলমান নর-নারী হজ্ব করছেন, কিন্তু কতজন মানুষ সত্যিকার মনোভাব/তাক্ওয়া এবং হজ্বের গুরুত্ব/ তাৎপর্য সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ নিয়ে হজ্ব করতে যান ? সম্ভবতঃ এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। হজ্ব সম্বন্ধে স্বচ্ছ এবং ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করা সকলের জন্যই অপরিহার্য। আমার এ বইটিতে হজ্বের সব কথা লিখলে বই এর আকার অনেক বড় হয়ে যাবে। তখন আর বইটি হ্যান্ডি থাকবে না, সফরে বইটি বহন করতেও কষ্ট হবে। তাই উমরাহ্ ও হজ্বের নিয়ম কানুন লিখার আগে খুব সংক্ষেপে হজ্বের সূচনা সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু কথা লিখলাম, যাতে হজ্ব পালনকারীদের মধ্যে বিভিন্ন বই পড়ে জ্ঞানার্জনের আগ্রহ জন্মে এবং হজ্বের কার্যক্রমে প্রধান ফরয ও ওয়াজিব আমলগুলোর উৎস সম্বন্ধেও কিছু ধারণা হয়।
ফিরিশতা কর্তৃক কা’বা ঘর নির্মাণ
পবিত্র হজ্বের ইতিহাস খুঁজলে প্রথমেই বাইতুল্লাহ্ শরীফের ইতিহাস জানতে হবে। এ পবিত্র ঘরটি সপ্তম আকাশে প্রতিষ্ঠিত ফিরিশতাদের ইবাদাত ঘর ‘বাইতুল মামুরের’ অনুকরণে এ ঘরের ঠিক সরাসরি নিচে পৃথিবীতে আল্লহ পাকের নির্দেশে ফিরিশতাদের দ্বারা বাবা আদম ও মা হাওয়া (আঃ) এর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়। ‘বাইতুল মামুর’ হলো আসমানে ফিরিশতাদের ইবাদাতগাহ, (সূরাঃ আত তূরঃ আয়াতঃ ৪)। প্রতিদিন ৭০ হাজার ফিরিশতা এ ঘরকে তওয়াফ করে এবং কিয়ামত পর্যন্ত ফিরিশতা কর্তৃক এ তওয়াফ জারী থাকবে। প্রতিদিন নতুন ফিরিশতাদের দল তওয়াফ করে (সূত্রঃ ইবনে কাসীর)।
অতঃপর পৃথিবীর এ ঘরটিই (কা’বা) ইবাদাতের ঘররূপে ব্যবহার করার জন্য আদম (আঃ) আদিষ্ট হন। ঘর নির্মাণ হয়ে যাওয়ার পর আদম (আঃ) কীভাবে আল্লহর ইবাদাত করবেন, তা জানার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, আল্লহ তাঁকে জানিয়ে দেন যে, ‘ফিরিশতারা যেভাবে ‘বাইতুল মামুর’ তওয়াফ (প্রদক্ষিণ) করে, তুমিও তেমনিভাবে ঐ ঘর (কা’বা ঘর) তওয়াফ করে আমার ইবাদাত করবে।’ কা’বার ইতিহাস থেকে আরো অনেক কিছু জানার আছে।
এ কথায় আদম (আঃ) দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভাবতে থাকেন ‘বাইতুল মামুর কত বড় সম্মানিত ঘর, আর এ ঘর তো আমাদের জন্য সাধারণ ঘর।’ অতএব, আদম (আঃ) এ ঘর তওয়াফ করে পরিপূর্ণ ভক্তি বা স্বাদ পাচ্ছিলেন না। আদম (আঃ) বেহেশতে থাকাকালীন ‘বাইতুল মামুর’ দেখেছেন, তাই তাঁর এমন অনুভূতি হয়েছে।
হাজরে আস্ওয়াদ (কালো পাথর) স্থাপন
আল্লহতাআ’লা আদম (আঃ)-এর মনের অবস্থা বুঝে, ফিরিশতাদের নির্দেশ দিলেন, ‘যাও বেহেশত হতে একটি হিরের টুক্রা নিয়ে ঐ ঘরের এক কোণে পুঁতে দাও।’ আল্লহর নির্দেশে ফিরিশতারা যখন ঐ হিরের টুক্রাটি ঐ ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে নিবিষ্ট করে দিলেন, তখন আল্লহর কুদরতী প্রভাব বিশাল আকারে বিকশিত হয়ে পড়লো। আদম (আঃ) তা দেখে চমকিত হয়ে ঐ ঘরের মূল্যায়নে আশ্চর্যান্বিত হলেন এবং আল্লহ্তাআ’লার প্রশংসায় বার বার সুব্হানাল্লহ্! সুব্হানাল্লহ্! বলতে লাগলেন। তিনি দেখলেন, ঐ হিরের টুক্রার কিরণ ও প্রখর জে্যাঁতিতে চতুর্দিকের বিশাল এলাকা আলোকিত হয়ে গেছে।
আল্লহর ঘর কা’বা শরীফের তওয়াফ শুরু
এ ব্যাপার দেখে আদম (আঃ) এর সকল দ্বিধাদ্বন্ধের অবসান হয়ে গেল। অতঃপর দারুণ ভক্তিভরে তিনি ঐ ঘরের তওয়াফে মশগুল হয়ে গেলেন, যা আজও পর্যন্ত চলছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত চলবে। আদম (আঃ)-এর এ স্মৃতি স্মরণীয় হয়ে ঐরূপ তওয়াফ, উমরাহ্ ও হজ্বের প্রধান ফরজ আরকানে পরিণত হয়ে রয়েছে এবং রোজ কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। এরপর বহু যুগ অতিবাহিত হয়েছে, বহু নবী-রসূল দুনিয়াতে এসেছেন। সকল পয়গম্বরই এ ঘর যিয়ারত করেছেন, তওয়াফও করেছেন।
অবশেষে নূহ (আঃ) এর জামানায় আল্লহর গযবে মহাপ্লাবন সংঘটিত হয়। ঐ প্লাবনে কা’বা শরীফের ভিত ছাড়া উপরের সকল অস্তিত্ব বিলুপ্ত/অদৃশ্য হয়ে যায়। আর আল্লহর কুদরতে ঐ বেহেশতী হিরের টুক্রাটি ‘জাবালে আবু কুবায়েস’ নামক পাহাড়ে (বর্তমানে সেস্থানে বাদশার প্যালেস নির্মিত হয়েছে) সংরক্ষিত হয়। এ পাথরটিই হাজরে আস্ওয়াদ নামে পরিচিত। আবহমান কাল থেকে তওয়াফের শুরুতে এবং শেষে এ পাথরটি চুম্বন করার রীতি প্রচলন হয়ে যায়।
ইব্রাহীম (আঃ)-এর আবির্ভাব, পুত্র সন্তান লাভ ও বিবি হাজেরার নির্বাসন
বর্তমান সিরিয়া দেশে পয়গম্বর হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর আবির্ভাব হয়েছিল। এ পয়গম্বরের জীবনেই বহু কঠিন কঠিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঘটনা ঘটেছিল এবং এসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় তিনি খলীলুল্লাহ (আল্লহর বন্ধু) খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। ইব্রাহীম (আঃ) এর সব ঘটনা এ বইতে লেখা সম্ভব নয়। তাই অতি সংক্ষেপে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা বর্ণনা করলাম। বিস্তারিত জানার জন্য ইব্রাহীম (আঃ) এর জীবনী পড়ূন।
ইব্রাহীম (আঃ)-এর প্রথম পত্নীর নাম বিবি সারা। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত এ স্ত্রীর গর্ভে কোনো সন্তান না হওয়ায় এবং আল্লহ পাকের দরবারে সন্তান কামনা করায়, আল্লহ্ তাআ’লা তাঁকে পুনরায় বিয়ে করার আদেশ দেন। তাঁর প্রথমা স্ত্রী সারা এ কথা জানতে পেরে হাজেরা নামী এক পরমা সুন্দরী যুবতীর সাথে তাঁর বিবাহের ব্যবস্থা করেন।
অতঃপর হাজেরার গর্ভে সন্তান আসে এবং যথা সময়ে তিনি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন, যার নাম রাখা হয় ইসমাঈল। শিশু ইসমাঈলের বয়স দুবছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই আল্লহর নির্দেশে শিশু পুত্রসহ মা হাজেরাকে নির্বাসনে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হয়। তখন ইব্রাহীম (আঃ) আল্লহর সন্তুষ্টি বিধানে, ফিরিশতা জিব্রাঈল (আঃ)-এর পথ নির্দেশে যথা সময়ে দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈল ও স্ত্রী হাজেরাকে নিয়ে জিব্রাঈল (আঃ)-এর সঙ্গে বোরাকে করে বাড়ী থেকে রওয়ানা দেন। অজানা-অচেনা পথ ধরে বহু জনপদ অতিক্রম করে জিবরাঈল (আঃ)-এর পথ-নির্দেশে বাক্কায় (মক্কায়), (যেখানে হযরত আদম (আঃ)-এর ইবাদতের জন্য কা’বা ঘর নির্মিত হয়েছিল এবং নূহ (আঃ)-এর জামানায় মহাপ্লাবনে যে ঘর অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল), সেস্থানে এসে পৌঁছলেন। আল্লহর ঘরটি ঐ সময় একটি টিলার আকারে বিদ্যমান ছিল।
জিবরাঈল (আঃ) এখানেই শিশু পুত্র ইসমাঈল ও স্ত্রী হাজেরাকে রেখে ইব্রাহীম (আঃ)-কে চলে যেতে বললেন, আর বললেন, ‘কোনো চিন্তা নেই, এক সময় এখানে আল্লহর ঘর ছিল, অতএব, মা ও ছেলে আল্লহর ঘরের পড়শী হয়ে থাকবে’। অতঃপর এখানেই একটি ঝুপড়ি তৈরি করে সঙ্গে আনা কিছু খেজুর ও মশকে কিছু পানি রেখে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এখানে ইব্রাহীম (আঃ) ও বিবি হাজেরার মধ্যে অনেক মর্মস্পর্শী কথাবার্তা হয়েছে (সবকিছু এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়)।
ইব্রাহীম (আঃ) প্রস্থান করলেন, আর বিবি হাজেরা শিশুপুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে, ‘তাওয়াক্কাল্তু আলাল্লাহ’ বলে আল্লহর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে রয়ে গেলেন।
ইব্রাহীম (আঃ) এর দুআ’ কবুল
ইব্রাহীম (আঃ) পথ চলতে চলতে আল্লাহর নিকট সবিনয়ে এ দুআ’ করলেন, ‘হে আল্লহ! আমি আমার বংশধরদের একাংশকে (এ নির্জন মরু প্রান্তরে) আপনার সম্মানিত গৃহের নিকটে চাষাবাদের অনুপযোগী অনুর্বর স্থানে বসবাস করালাম। হে আল্লহ! তারা যাতে নামাজ কায়েম করে, আর কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও, ফল-ফসল দ্বারা তাঁদের জীবিকা দাও যাতে তাঁরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে’ (সূরাঃ ইব্রাহীম আয়াতঃ ৩৭)। আল্লহ ইব্রাহীম (আঃ)-এর দুআ’ কবুল করলেন।
জমজম কূপের উৎপত্তি
কয়েকদিনের মধ্যেই খেজুর ফুরিয়ে গেল এবং মশকের পানিও নিঃশেষ হয়ে গেল। প্রখর রোদের তাপে পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় বিপর্যস্ত বিবি হাজেরা আল্লহর উপর নির্ভর করে ধৈর্য ধরে এক অনিশ্চয়তার ভিতর দিনাতিপাত করছিলেন। এমন সময় বিবি হাজেরা এক গায়েবী আওয়াজ শুনতে পেলেন, ‘হে হাজেরা! তুমি সাবধান হয়ে যাও, সতর্ক হও, তোমার ঐ শিশু বাচ্চার পেশানিতে ‘নূরে মোহাম্মদী (সঃ)-এর আমানত আছে।’ নবীর বিবি এতোটুকু ইশারাতেই সবকিছু অনুধাবন করে পানি সংগ্রহের ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
পানি ছাড়া শিশু বাচ্চাকে বাঁচানো সম্ভব নয় চিন্তা করে, পানির অনুসন্ধানে প্রথমেই সম্মুখের সাফা পাহাড়ে উঠে চতুর্দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন, কিন্তু কোনো জনপদ বা পানির সন্ধান না পেয়ে নেমে এলেন। সমতল নিম্নভ‚মিতে এসে অনতিদূরে শুইয়ে রেখে আসা বাচ্চাটির দিকে তাকালেন, কিন্তু এ নিম্নভূমি থেকে বাচ্চাটিকে না দেখতে পেয়ে দারুণ পেরেশানী অবস্থায় অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে সম্মুখের আরো একটি মারওয়া পাহাড়ে উঠার জন্য দৌড়াতে লাগলেন, যাতে বাচ্চাটিকে দেখা যায়।
একটু উঁচুতে উঠেই দেখতে পেলেন বাচ্চাটি হাত-পা দুলিয়ে খেলা করছে। তখন একটু নিশ্চিন্ত হয়ে মারওয়া পাহাড়ের শীর্ষে উঠে চতুর্দিকে তাকিয়ে কোনো জনপদ না দেখে, কোনো পানির সন্ধান না পেয়ে পাহাড় থেকে নিম্নভূমিতে নেমে এসে বাচ্চাটিকে দেখতে না পেয়ে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে সাফা পাহাড়ে উঠে বাচ্চাকে দেখলেন এবং পানির সন্ধান না পেয়ে মারওয়া পাহাড়ে ফিরে এলেন। এমনিভাবে পানির সন্ধানে ৭ বার সাফামারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়াদৌড়ি করলেন।
সপ্তমবারের মাথায় মারওয়া পাহাড় থেকে নিম্ন ভূমির দিকে আসার সময় দেখতে পেলেন যে, বাচ্চাটির পায়ের নিচেই একটি পানির উৎস সৃষ্টি হয়েছে। এটা দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বার বার ‘সুব্হানাল্লহ, আল্হাম্দুলিল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্, আল্লহু আকবার’ বলতে বলতে বাচ্চার নিকট এসে বালু কণা দিয়ে বাঁধ তৈরি করে পানির প্রবাহকে আটকালেন। আল্লহর অসীম কুদরতে সে উৎস গভীরে পরিণত হয়ে সেখানে এক অতল কূপের সৃষ্টি হলো, যা আজও যম্ যম্ কূপ নামে পরিচিত।
এ কূপটি কা’বা ঘরের পূর্বে এবং মাকামে ইব্রাহীমের অদূরে দক্ষিণ দিকে প্রায় ৫৫ হাত দূরে বিদ্যমান, বর্তমানে যদিও কূপটি দেখা যায় না। কারণ তওয়াফের সুবিধার্থে কূপের উপরিভাগে ছাদ তৈরি করে তওয়াফের চত্বরের সাথে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে। বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন, মদীনা পাবলিকেশন্সএর ‘পবিত্র যমযম’ এ্যলবামটি।
সায়ীর প্রবর্তন বা সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে ৭ বার দৌড়াদৌড়ি
এখানে উল্লেখ্য, মা হাজেরা দু’পাহাড়ের মাঝখানে যে নিম্ন ভূমিতে দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন, সে স্থানটুকু
বর্তমানে সবুজ টিউব লাইট দ্বারা চিহ্নিত করা আছে, যেখানে পুরুষ হাজীগণ দৌড়িয়ে অতিক্রম করেন। মা হাজেরার স্বীয় শিশু বাচ্চাটিকে বাঁচাবার প্রচেষ্টায় উন্মাদিনীর ন্যায় ‘সাফা-মারওয়া’ পর্বতদ্বয়ের মধ্যে দৌড়াদৌড়িকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্যই আল্লহ তাআ’লা হজ্ব ও উমরাহর কার্যক্রমে এ স্থানে ‘সায়ী’ করা ওয়াজিব আরকানে পরিণত করেছেন। (সূরা বাকারা ঃ আয়াত ১৫৮)
খেজুর গাছের অলৌকিক ফলন
হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর দুআ’র বরকতেই বাক্কায় (মক্কায়) বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল।
কূপের পানি পেয়ে মাতা হাজেরা মহা আনন্দে বাচ্চাকে নিয়ে পরম সুখে দিন যাপন করতে লাগলেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর রেখে যাওয়া খেজুরগুলো খাওয়ার পর তার দানাগুলো আশে পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল, যমযম কূপের পবিত্র পানির পরশ পেয়ে দানাগুলো থেকে গাছ গজিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে অলৌকিকভাবে গাছগুলোতে খেজুর এসে গেল। এ ঘটনায় বিবি হাজেরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বার বার আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করতে লাগলেন।
জুরহুম গোত্রের বসতি স্থাপন
খেজুর গাছের অলৌকিক ফলনের কিছুদিন পর আরো একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটলো। ইয়ামেনের জুরহুম গোত্রের একটি কাফেলা এ নির্জন মরু প্রান্তের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় একঝাঁক পাখি আকাশে উড়তে দেখে তারা পানির সন্ধানে বিবি হাজেরার নিকট এসে পানি ব্যবহারের এবং সেখানে বসবাস করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করল। দয়াময়ী মা হাজেরা তাদেরকে বসবাসের অনুমতি দিলেন, কিন্তু একটি শর্ত জুড়ে দিলেন।
তিনি বললেন, ‘আমি যেমন তোমাদেরকে পানি ব্যবহার করতে দিলাম, ঠিক তোমরাও এখানে আগত সকলকে পানি ব্যবহারের জন্য এ কূপকে উন্মুক্ত রাখবে। জুরহুম গোত্রের লোকেরা মা হাজেরার আন্তরিক উপদেশ অন্তর দিয়েই গ্রহণ করে সেখানে বসবাস আরম্ভ করে দিল। আস্তে আস্তে জনবসতি বৃদ্ধি পেতে লাগলো। শিশু ইসমাঈলের বয়সও বাড়তে লাগলো।
ইব্রাহীম (আঃ) মাঝে মাঝে এসে বিবি-বাচ্চাকে দেখে যেতেন, খোঁজ খবর নিতেন। সুমিষ্ট পানির কূপ, খেজুর বাগান এবং জুরহুম গোত্রের ছোট্ট একটি বসতি দেখে আল্লহর দরবারে ইব্রাহীম (আঃ) শত সহস্রবার শুকরিয়া আদায় করেছেন।
কুরবানির প্রচলন
কুরবানির ঘটনাতো সকলেরই জানা। তবুও খুব সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করছি। ইসমাঈলের বয়স যখন ৮/৯ বছর, তখন পিতা ইব্রাহীম (আঃ) হঠাৎ স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হলেন আল্লহর নামে কুরবানি করার জন্য। তিনি কিছু উট কুরবানি দিলেন। আবার স্বপ্ন দেখলেন, এ স্বপ্নের তাবীরে (ব্যাখ্যায়) তাঁর ধারণা হলো, উট কুরবানি নয়, তাঁর একমাত্র পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানী দেয়া আল্লহ পছন্দ করছেন। তিনি পুনরায় এক অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হলেন।
তিনি চিন্তা ভাবনা করে নিশ্চিত হলেন যে, ইসমাঈলকেই কুরবানি দেয়ার নির্দেশ হয়েছে। তিনি যথা সময়ে সিরিয়া হতে রওয়ানা হয়ে স্ত্রী-পুত্রের নিকট উপস্থিত হলেন এবং স্ত্রীকে সব কথা খুলে বললেন, ‘আল্লহর নামে পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানি করতে আমি আদিষ্ট হয়েছি।’ পয়গম্বরের স্ত্রী হাজেরা আল্লহর মর্জির উপর রাজী হয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে পুত্রকে সুসজ্জিত করে তার পিতার সাথে রওয়ানা করিয়ে দিলেন।
শয়তানের অসওয়াসা (কুমন্ত্রণা)
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা এলাকা অতিক্রম করে মীনা এলাকায় প্রবেশ করেন। এমন সময় বিতাড়িত শয়তান ৮/৯ বছরের ছেলে ইসমাঈলের কানে কানে কুমন্ত্রণা দিয়ে বলতে লাগলো, ‘তোমার পিতার সঙ্গে যেয়ো না, তোমার পিতা তোমাকে জবাই করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে।’ একাধিকবার শয়তান ইসমাঈলকে একই কথা বলতে থাকায় অল্প বয়স্ক ছেলে ইসমাঈল পিতাকে ডাক দিয়ে বলল, ‘আব্বাজান, কারা যেন বার বার আমাকে বলছে, তুমি তোমার পিতার সঙ্গে যেয়ো না, তোমার পিতা তোমাকে জবাই করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে’।
ছেলের মুখে এ কথা শুনে ইব্রাহীম (আঃ)- এর মুখমন্ডল লাল হয়ে গেল, তিনি দৃঢ়তার সাথে বললেন, ‘শয়তান পিছু লেগেছে, তুমি পাথর ছুড়ে তাদের মারো’। কিন্তু পরক্ষণেই ইব্রাহীম (আঃ) বললেন, ‘বাবা যা শুনেছ তা ঠিকই শুনেছ, আমি তোমাকে আল্লহর নামে কুরবানি দেয়ার জন্যই নিয়ে যাচ্ছি।’ আশ্চর্যের ব্যাপার!
এ অল্প বয়স্ক ছেলেটি পিতার মুখে এ কথা শুনে বিন্দুমাত্র ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে খুবই উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘আব্বাজান, এখনই আপনি আমাকে আল্লহর নামে কুরবানি করুন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন, আমি ধৈর্য ধারণ করবো, আহ্! উহ্! শব্দও করবো না।’ অতি দৃঢ়তার সঙ্গে এমন আত্মসমর্পণ উক্তির জন্যই নাবালক বয়সেই ইসমাঈল (আঃ) নবীর দরজা প্রাপ্ত হন এবং ‘যবীহুল্লাহ্’ খেতাবে ভ‚ষিত হন।
কুরবানি অনুষ্ঠিত
অতঃপর হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ‘জাবালে কাবশের’ পাদদেশে ইসমাঈলকে শুইয়ে দিয়ে জবেহ করতে উদ্যত হলেন, এমন সময় আল্লহ্তাআ’লা ফিরিশতাদের দেখিয়ে
বলেন, ‘তোমরা দেখ, আমার খলীল সর্বাধিক আমাকেই ভালবাসে, তাই আমার নির্দেশ পালনার্থে প্রাণপ্রিয় একমাত্র পুত্রকে আমার নামে কুরবানি করতে কোনো দ্বিধা করেনি। আমি তার উৎসর্গকৃত কুরবানি কবুল করে নিয়েছি, তাকে আর অগ্রসর হতে দিও না, এখনই বেহেশত হতে একটি দুম্বা নিয়ে ঐ স্থানে শুইয়ে দাও, আর ইসমাঈলকে সরিয়ে নাও’। চোখের পলকে এ কাজ সমাধা হয়ে গেল, ইসমাঈল (আঃ) পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন, আর বেহেশতী দুম্বা জবেহ হয়ে গেল। এ ঘটনা থেকে আমাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব হয়ে গেল। (সূরা: সফ্ফাত,১০২ থেকে ১০৮ নং আয়াত দ্রষ্টব্য)
তাক্বীরে তাশরীক এর উৎপত্তি
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) আর ফিরিশতারা এ দৃশ্য দেখে বলতে শুরু করলেন, ‘আল্লহু আকবার, আল্লহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অল্লাহু আকবার, আল্লহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হাম্দ’। এ তাকবীরকে, ‘তাক্বীরে তাশরীক’ বলা হয়।
এ মহান ঘটনাকে কেন্দ্র করেই প্রতি বছর ১০ যিল্হজ্ব সারা বিশ্বের মুসলমানদের প্রতি পশু কুরবানি করা ওয়াজিব সাব্যস্ত করা হয়েছে, আর ৯ যিল্হজ্ব ফজরের নামাজের পর হতে ১৩ যিল্হজ্ব আসরের নামাজ পর্যন্ত প্রতি ওয়াক্তে (মোট ২৩ ওয়াক্ত) উক্ত তাকবীর একবার পাঠ করা ওয়াজিব আ’মল হিসেবে গণ্য হয়ে গেল। অর্থাৎ হজ্বের ফরজ ও ওয়াজিব আ’মলগুলো এক একটি অলৌকিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে নির্ধারণ করা হয়েছে।