হজ্বের প্রক্রিয়া ও তওয়াফের প্রচলন
হজ্বের প্রক্রিয়া
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ) কর্তৃক কা’বা ঘর তৈরি হয়ে যাবার পর আল্লহতাআ’লার নির্দেশে যে জ্যোতির্ময় হীরক খন্ডটি আদম (আঃ)-এর জামানায় সর্ব প্রথম নির্মিত এ ঘরের এক কোণে স্থাপন করা হয়েছিল এবং যেটি নূহ (আঃ)-এর জামানায় মহাপ্লাবনের সময় ‘আবু কোবায়েস’ পর্বতে আমানত রাখা ছিল, সে স্থানটি জিবরাঈল (আঃ) হযরত ইসমাঈল (আঃ)-কে দেখিয়ে দেন।
তখন তিনি (ইসমাঈল আঃ) উক্ত জ্যোতির্ময় পাথরটি নিয়ে এলে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তা নির্ধারিত কোণে স্থাপন করে দেন। এভাবে নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হলে আল্লহ্ তাআ’লা তাঁর প্রিয় খলীল ইব্রাহীম (আঃ)- কে আদেশ করলেন, ‘হে ইব্রাহীম! তুমি সারা বিশ্বে ঘোষণা করে দাও, তারা যেন এ ঘর যিয়ারত করতে অর্থাৎ হজ্ব করতে এখানে হাজির হয়’ (সূরাঃ হজ্ব, আয়াতঃ ২৭)
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) বললেন, ‘হে আল্লহ্, আমার গলার স্বর আর কত উচ্চ হবে যে, সকলেই শুনতে পাবে।’ আল্লহ্ তাআ’লা বললেন, ‘হে ইব্রাহীম, তুমি আওয়াজ দাও, সে আওয়াজ সারা জাহানে কিভাবে পৌঁছবে, সে বিষয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।’ এ আশ্বাস পেয়ে পরম উৎফুল্লের সাথে ইব্রাহীম (আঃ) বিশ্বমানবের উদ্দেশ্যে ‘পবিত্র হজ্বের’ দাওয়াত দিলেন।
কথিত আছে, এ আওয়াজ আল্লহর কুদরতে এতো বুলন্দ ছিল যে, সারা জাহান এমন কি ‘আলমে আরওয়াহ্’ (রূহের জগত) হতেও লাব্বাইক (আমি হাজির আছি) বলে জবাব এসেছিল।
হারাম, হিল্ ও মীকাতের সীমানার বিবরণ
ইব্রাহীম (আঃ)-এর ঘোষণার পর হতেই উমরাহ্ ও হজ্বের প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথমেই আল্লহ পাকের নির্দেশে জিবরাঈল (আঃ) হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-কে হারাম, হিল্ ও মীকাতের সীমানা নির্ধারণ করে দেন।
ক। হারাম শরীফের সীমানা বা হুদুদে আরকামঃ হযরত আদম (আঃ)-এর জামানায় প্রথম এ ঘর নির্মাণের পর যে জ্যোতির্ময় পাথর ঐ ঘরের এক কোণায় স্থাপন করাতে তার কিরণ যতদূর বিচ্ছুরিত হয়েছিল, ততদূর এলাকা পর্যন্ত হারাম শরীফের সীমানা বলে চিহ্নিত করা হয়। ঐ সমস্ত সীমানায় ছোট ছোট গম্বুজ বিশিষ্ট তিনটি করে জোড়া পিলার সন্নিবেশিত আছে।
খ। মীকাতের সীমানাঃ ঐ সময় উক্ত জ্যোতির্ময় পাথরের তীব্র কিরণ দেখে শয়তান ভীত হয়ে যতদূর পর্যন্ত এলাকা অতিক্রম করে পালিয়ে গিয়েছিল, ততদূর এলাকা মীকাতের সীমানা বলে চিহ্নিত হয়।
অবশ্যই ঐ সব এলাকার নাম ধরে উল্লেখ করা আছে। যেমন
এশিয়া এলাকার দিকে মীকাতের নাম ইয়ালাম লাম। হারাম শরীফের সীমানা হতে মীকাতের সীমানার মধ্যবর্তী স্থানের নাম ‘হিল’ বলে অভিহিত। এসব এলাকা ভিত্তিক সীমানা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর জামানা হতে সুস্পষ্টরূপে নির্ধারিত হয়ে আছে।
মুযদালিফায় রাত্রি যাপনের কাহিনী
সূরাঃ বাকারার ৩৬নং আয়াত, সূরাঃ ত্বহা-র ১২০, ১২১ ও ১২৩নং আয়াত এবং সূরাঃ আ’রাফ এর ১৯ ও ২২ আয়াতের আলোকে দেখা যায়, শয়তানের ধোঁকায়/প্ররোচনায় নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে আল্লহর হুকুম মানার ক্ষেত্রে ভূল হওয়ার করার কারণে আল্লহ্ বাবা আদম ও মা হাওয়াকে দুনিয়াতে পাঠিয়ে দেন।
তারপর থেকে সুদীর্ঘ কাল বিচ্ছেদের পর আরাফার ময়দানে এসে উভয়ের মধ্যে পরিচয় হবার পর আদম (আঃ) বিবি হাওয়াকে বললেন, ‘তোমাকে তো পেয়ে গেলাম, এখন আমরা কোথায় যাব?
চারদিক তো মরু প্রান্তর বালুকাময় পাহাড় পর্বত, কোনো আরামের স্থানের চিহ্ন মাত্র নেই। চলো সামনের দিকে হেঁটে দেখা যাক, কোথায় কী আছে। এই বলে তাঁরা হাঁটতে আরম্ভ করেন। বেশ কিছুদূর হাঁটার পর, এখন যে স্থান ‘মুযদালিফা’ নামে খ্যাত, সেখানে একটি ‘জাবালে কুজা’ (বক্রবিশিষ্ট) পর্বত দেখতে পেলেন। পবর্তটি এমনভাবে বেঁকে ঝুলে আছে, যেন তার ভেতরটা একটা ঘরের / গুহার মতো।
এ পাহাড়টি দেখে আদম (আঃ) বললেন, দিনের অবসান হয়েছে, অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, আর অগ্রসর না হয়ে এ পর্বত গুহায় রাত্রি যাপন করা যাক। এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেখানে তাঁরা রাত্রি যাপন করলেন।
পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী দীর্ঘকাল বিরহের পর দুনিয়াতে সর্বপ্রথম যে স্থানে রাত্রিযাপন করেছিলেন, সে স্থানটিকে কিয়ামত পর্যন্ত স্মরণীয় করে রাখার জন্যই হজ্বের কার্যক্রমের মধ্যে ৯ যিল্হজ্ব তারিখে আরাফাতে অবস্থানের পর দিবাগত রাত্রে মুযদালিফায় জাবালে কুজা এলাকায় (যেখানে মসজিদে মুযদালিফা নির্মিত হয়েছে, যা ‘মাশ্আ’রিল হারাম’ নামে অভিহিত) রাত্রি যাপন করা হজ্বের একটি ‘ওয়াজিব’ আরকান হয়ে রয়েছে।
তওয়াফের প্রচলন
পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর কা’বা শরীফ প্রদক্ষিণ করে তওয়াফের সূচনা করেন হযরত আদম (আঃ), অতঃপর তাঁর সন্তান সন্ততিগণ এবং পরবর্তী নবীগণ। হযরত নূহ (আঃ)-এর জামানায় মহা প্লাবনে এ ঘরটি অদৃশ্য হয়ে দৃষ্টির অন্তরালে চলে যায়। এ ঘটনার বহু যুগ পরে আল্লহ্তা আ’লার নির্দেশে কা’বা ঘর পুনঃনির্মাণ করেন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও তার ছেলে ইসমাঈল (আঃ)।
এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আল্লহ পাক ইরশাদ করেন, ‘যখন আমি ইব্রাহীমের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম সে ঘরের স্থান, তখন বলেছিলাম, আমার সাথে কোনো শরীক স্থির করো না এবং আমার ঘরকে পবিত্র রেখো তাদের জন্য, যারা তওয়াফ করবে এবং যারা সালাতে দাঁড়াবে, রুকু করবে ও সিজদা করবে।’ (সূরাঃ হজ্ব, আয়াতঃ ২৬)
অন্যত্র আল্লহ আরো ইরশাদ করেন, ‘সে সময়ের কথা স্মরণ করো, যখন কা’বা ঘরকে মানবজাতির মিলন কেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম এবং বলেছিলাম, ‘তোমরা মাকামে ইব্রাহীমকেই নামাজের স্থানরূপে গ্রহণ করো। আর ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে তওয়াফকারী, এতেকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য আমার ঘরকে পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছিলাম।’ (সূরাঃ বাকারা, আয়াতঃ ১২৫)
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও পুত্র ইসমাঈল (আঃ) প্রার্থনা করেছিলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের উভয়কে তোমার একান্ত অনুগত করো এবং আমাদের বংশধর হতে তোমার অনুগত একদল উম্মত করো। আর আমাদেরকে ইবাদাতের (অর্থাৎ হজ্বের) নিয়ম পদ্ধতি দেখিয়ে দাও আর আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হও। অবশ্যই তুমি তাওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু।’ (সূরাঃ বাকারা, আয়াতঃ ১২৮)
ইতিপূর্বে আল্লহ্তাআ’লা জিবরাঈল (আঃ)-এর মাধ্যমে হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-কে কা’বা ঘরের ভিত্তি দেখিয়ে দিয়ে তা পুনঃনির্মাণ করার আদেশ দিয়েছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও পুত্র ইসমাঈল (আঃ) মিলিতভাবে নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে পিতা-পুত্র একত্রে আল্লহ পাকের নিকট দুআ’ করেছিলেন, ‘রব্বানা তাকব্বাল মিন্নাঁ ইনঁনাকা আন্ঁতাস সামীউল আ’লীম’
অর্থ ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের এ কাজ গ্রহণ করো। তুমি নিশ্চয় সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা’। (সূরাঃ বাকারা, আয়াতঃ ১২৭)
শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের প্রচলন
নবীদ্বয়ের মোনাজাতের পর আল্লহতাআ’লা হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-কে হজ্বের দিক-নির্দেশনা দেয়ার জন্য জিবরাঈল (আঃ)-কে নিযুক্ত করলেন। জিবরাঈল (আঃ) ইব্রাহীম (আঃ)-কে প্রথমে সাফা পর্বতে নিয়ে গিয়ে বললেন, এটা আল্লহ তাআ’লার নির্ধারিত হজ্বের একটি স্থান। তারপর মারওয়া পর্বতে নিয়ে গিয়ে বললেন, এটাও আল্লহর নির্ধারিত অপর একটি স্থান।
জিবরাঈল (আঃ) তারপর তাঁকে মীনায় নিয়ে গেলেন। সেখানে তাঁরা জামরাতুল আকাবায় (বড়) পৌঁছে ইবলীস শয়তানকে দেখতে পেলেন। হযরত জিবরাঈল (আঃ) ইব্রাহীম (আঃ)-কে বললেন, আপনি ‘তাকবীর’ বলে শয়তানের দিকে পাথর নিক্ষেপ করুন। ইব্রাহীম (আঃ) তার প্রতি ৭ টি পাথর নিক্ষেপ করলেন।
তখন ইবলীস শয়তান সেখান থেকে সরে গিয়ে জামরাতুল উস্তায় (মেঝো) গিয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা সেখান দিয়ে অতিক্রমকালে জিবরাঈল (আঃ)-এর পরামর্শে ইব্রাহীম (আঃ) পুনরায় ‘তাক্বীর’ বলে শয়তানকে ৭ টি পাথর নিক্ষেপ করেন। তারপর উভয়ে যখন জামরাতুল উলায় পৌঁছলেন, দু’শয়তান এখানেও তাঁদের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। পরামর্শ অনুযায়ী ইব্রাহীম (আঃ) প্রত্যেকবার ‘তাকবীর’ বলে ৭ টি পাথর নিক্ষেপ করলে শয়তান সত্যিই দূর হয়ে যায়। হজ্বের কার্যক্রমে ৩ টি জামরাতে পাথর নিক্ষেপ করার সিলসিলা (যা হজ্বের কার্যক্রমে ওয়াজিব আ’মল) এখান থেকেই শুরু হয়, যা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।