সাফা-মারওয়া সায়ী করার নিয়মাবলী ও সায়ী করার চিত্র
সাফা-মারওয়া সায়ী করার নিয়মাবলী
১। ‘সায়ী’ শব্দের অর্থ হচ্ছে চেষ্টা করা, দৌড়ানো এবং দ্রুত চলা। ইসলামী পরিভাষায় সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানটি প্রদক্ষিণ করাকে সায়ী বলে। সাফা ও মারওয়া আল্লহ-তাআলার নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি। এ প্রসঙ্গে আল্লহ্তাআ’লা এরশাদ করেনঃ-
اِنَّ الصَّفَا وَ الۡمَرۡوَۃَ مِنۡ شَعَآئِرِ اللّٰهِ ۚ فَمَنۡ حَجَّ الۡبَیۡتَ اَوِ اعۡتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡهِ اَنۡ یَّطَّوَّفَ بِهِمَا ؕ وَ مَنۡ تَطَوَّعَ خَیۡرًا ۙ فَاِنَّ اللّٰهَ شَاکِرٌ عَلِیۡمٌ ﴿۱۵۸﴾
অর্থ : ‘নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া হচ্ছে আল্লহ্ তাআ’লার নিদর্শনসমূহের অন্যতম’। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা কা’বা ঘরের হজ্ব বা উমরাহ্ করে, তাদের পক্ষে এ দু’টিতে প্রদক্ষিণ করায় কোনো দোষ নেই। যদি কোনো ব্যক্তি অন্তরের নিষ্ঠার সাথে কোনো কাজ করে, (তাহলে আল্লহ্ অবশ্যই তার খবর রাখেন এবং সর্বাবস্থায় তার বিনিময় দান করেন) নিশ্চিয়ই আল্লহ্ যথার্থ পুরস্কার দাতা, সর্বজ্ঞাত। (সূরা বাকারাঃ ১৫৮ নং আয়াত দ্রষ্টব্য)
২। যদি কেউ ভাবেন মক্কায় গিয়ে সাফা ও মারওয়া নামে দুটি পৃথক পাহাড় দেখতে পাবেন, তাহলে পাহাড় দুটির বর্তমান অবস্থা দেখে হয়রান হবেন এবং পাহাড় দুটি দৃশ্যমান না হওয়াতে অবাক দৃষ্টিতে খুঁজতে থাকবেন। বর্তমানে সাফা পাহাড়ের চূড়াটি দেখতে পাবেন। কিন্তু মারওয়া পাহাড়ের অস্তিত্ত নেই বললেই চলে। তবে বেইজমেন্টে গেলে দুটি পাহাড়েরই অংশ বিশেষ দেখতে পাবেন।
৩। যমযমের পানি পান করে সায়ী করার জন্য সাফা পাহাড়ের দিকে যাবার পূর্বে আর একবার ইস্তিলাম (৮ম ইস্তিলাম) করুন। দূর থেকে হলেও ডান হাতের তালু দ্বারা ইশারা করে ইস্তিলাম করে সাফার দিকে অগ্রসর হোন।
৪। সাফা পাহাড়ের নিকটে গিয়ে কা’বা শরীফের দিকে মুখ করে দাঁড়ান। বর্তমানে এ স্থান থেকে কা’বা শরীফ পরিস্কার ভাবে দেখা যায় না। একটু এদিক সেদিক নড়াচড়া করলে মাসজিদুল হারামের পিলারগুলোর ফাঁক দিয়ে কালো গিলাফ চোখে পড়ে। এ মুহূর্তে কা’বা দেখা জরুরী নয়। এখানে দাঁড়িয়ে উপরের আয়াতটি পড়ূন, সম্পূর্ণ আয়াতটি মুখস্থ না থাকলে অন্তত আয়াতের প্রথম অংশটি অর্থাৎ ‘ইন্নাঁস্ সফা ওয়াল মারওয়াতা মিন' শাআ’ইরিল্লাহ্’ এ অংশটি বারবার পড়ূন। এরপর মনে মনে এভাবে নিয়ত করুন-‘হে আল্লহ্! আমি সাফা ও মারওয়ার মাঝে ৭ বার সায়ী করার নিয়ত করলাম। তুমি আমার জন্য এ কাজ সহজ করে দাও এবং কবুল কর’।
৫। নিয়ত শেষ করে নিচের তাক্বীর ও দুআ’গুলো পড়ূন। ৩ বার আল্লহর হাম্দ ও ছানা নিম্ন স্বরে পড়ুন (মহিলাগণ মনে মনে)।
(ক) ‘আল্লহু আকবার, আল্লহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ’।
(খ) ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াল হাম্দু লিল্লাহি ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার। ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুউয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজীম ’।
(গ) ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুল্কু ওয়ালাহুল হাম্দু ইউহয়ী ওয়া ইউমীতু ওয়া হুওয়া আ’লা কুল্লি শাইয়্যিন ক্বদীর।’ এ দুআ’ গুলো মুখস্থ করে ফেলুন।
৬। এর পর কয়েকবার দরূদ শরীফ পাঠ করে, সংক্ষিপ্ত দুআ’ মুনাজাত করে সাফা থেকে মারওয়ার দিকে অগ্রসর হতে হবে।
৭। সাফা থেকে কিছুদূর অর্থাৎ ৭৫ মিটার যাওয়ার পরেই সিলিং এর মধ্যে সবুজ রংয়ের টিউব লাইট দিয়ে চিহ্নিত ৫৫ মিটার স্থানটুকু পুরুষদের জন্য মধ্যম গতিতে দৌড়ে অতিক্রম করতে হবে (মহিলাদের জন্য দৌড়াতে হবে না ) এবং তখন এ দুআ’ পড়তে হবে-
‘রব্বিগ্ র্ফি ওয়ারহাম্ ওয়া আন্তাল আআ’য্যুল আক্রাম’ (অর্থ: হে আল্লহ! আমায় ক্ষমা করো, দয়া করো। তুমি পরাক্রমশালী ও মহান)।
৮। এরপর স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে মারওয়া পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হতে হবে। পথিমধ্যে প্রত্যেক সায়ীর জন্য আলাদা আলাদা কোনো দুআ’ করার বিধান নেই। যেকোনো দুআ’, দরূদ, তাসবীহ-তাহলীল পড়তে পড়তে মারওয়া পাহাড়ে পৌঁছলে একটি সায়ী সম্পন্ন হবে। এভাবেই তওয়াফের ন্যায় প্রত্যেক সায়ীতে ছোট ছোট দুআ’-দরূদ, তাসবীহ - তাহলীল পড়তে পড়তে ৭ বার সায়ী সম্পন্ন করুন।
৯। পুনরায় মারওয়া পাহাড় থেকে কা’বা শরীফের দিকে মুখ করে নিয়ত ব্যতীত (এখান থেকে কা’বা শরীফ দেখা যায় না, তবে ফ্লোরে নামাজের জন্য যে দাগ দেয়া আছে, সেটা দেখলেই কা’বার দিক-নির্ণয় করা যায়) হাম্দ, ছানা ও দু‘আ ইত্যাদি শেষ করে সাফার দিকে অগ্রসর হতে হবে। সবুজ রং এর বাতি দিয়ে চিহ্নিত স্থানটুকু পূর্বের মতো দৌড়িয়ে নির্ধারিত দুআ’টি পড়তে পড়তে অতিক্রম করে সাফা পাহাড়ে পৌঁছলে দ্বিতীয় সায়ী শেষ হবে।
১০। পুনরায় সাফা পাহাড়ে পূর্বের নিয়মে দুআ’ মুনাজাত ইত্যাদি করে সায়ী শুরু করে মারওয়াতে পৌঁছলে তৃতীয় সায়ী সমাপ্ত হবে। একই নিয়মে ৭ বার সায়ী করতে হবে। সপ্তম সায়ী মারওয়া পাহাড়ে গিয়ে শেষ হবে।
১১। সপ্তম সায়ী শেষ করে মারওয়া পাহাড়ে বসে অথবা দাঁড়িয়ে কা’বা শরীফের দিকে মুখ করে আল্লহর নিকট শুকরিয়া আদায় করে মন খোলা দুআ’ মুনাজাত করে সায়ী সমাপ্ত করতে হবে। সায়ী করার চিত্রটি দেখে নিন।
১২। সায়ী করার সময় তড়িঘড়ি করবেন না। ধীরস্থিরভাবে দৃঢ়পদে অন্তর চক্ষু দিয়ে মা হাজেরার অসহায়ত্বের ছবি এঁকে সায়ী করুন। কল্পনার চোখ দিয়ে তখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতির কথা স্মরণ করতে চেষ্টা করুন। এখানেও বহু হাজী নানাবিধ দুনিয়াবী কতাবার্তা বলতে বলতে সায়ী করেন। খবরদার! আপনি যেন এমনটি না করেন।
সাফা-মারওয়া সায়ী করার চিত্র
বিঃ দ্রঃ
(১) সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় ৪০০ মিটার।
(২) ৭ বার সায়ীতে প্রায় ৩.৫ কিঃ মিঃ হাঁটতে হয়।
(৩) সাফা থেকে মারওয়ার দিকে ৭৫ মিটার অগ্রসর হলে প্রথম সবুজ লাইট। আরও কিছু দূর অগ্রসর হলে দ্বিতীয় সবুজ লাইট। দুই সবুজ লাইটের মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় ৫৫ মিটার। এ স্থানটিতে পুরুষদের ধীর গতিতে দৌড়িয়ে অতিক্রম করতে হয় এবং নির্ধারিত দুআ’ পড়তে হয়।
(৪) সাফা পাহাড়ের অংশ চূড়াসহ দৃশ্যমান, কিন্তু মারওয়া পাহাড়ের অস্তিত্ব/চিহ্ন নেই বললেই চলে। তবে বেজমেন্টে গেলে মারওয়া পাহাড়ের চূড়া দেখা যায় এবং উভয় পাহাড়ের অংশ বিশেষ দেখা যায়।
(৫) প্রত্যেক সায়ীতে মানুষের বানানো নির্ধারিত লম্বা লম্বা দুআ’ করা সঠিক নয়। তবে তওয়াফের মতো যে কোনো ছোট ছোট দুআ’ করা যায়।
(৬) সাফা পাহাড়ের চূড়ায় বসে দুআ’ করা ভুল। বর্তমানে কাঁচের ব্যারিকেড দিয়ে সেখানে উঠা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
(৭) সাফা-মারওয়া পাহাড়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করা বিদ্আত।
(৮) সায়ী করার সময় বেহুদা কথা-বার্তা বলা নিষেধ।
(৯) প্রয়োজন হলে সায়ী করার পূর্বে পেশাব-পায়খানার কাজ সেরে নিয়ে সায়ী শুরু করবেন। কারণ সায়ী করতে অনেক সময় লাগে।
(১০) সায়ী করার সময় মা হাজেরা ও শিশু ইসমাঈলের দৃশ্যপট স্মরণ করতে করতে সায়ী করুন।
(১১) সায়ী করার সময় প্রয়োজনে পানি পান করা এবং কিছুক্ষণ বিশ্রাম করা জায়েয।