হজ্বের সংজ্ঞা হজ্জ কাকে বলে? হজ্জ্বে মাবরুর কি?
হজ্বের সংজ্ঞাঃ
দু’লাইনেই হজ্বের সংজ্ঞা লেখা যায়, কিন্তু আমি এ সংজ্ঞাকে অনেক ভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়ে বিস্তারিত ভাবে লিখলাম। কারণ হজ্ব কি বা হজ্ব কাহাকে বলে, প্রথমেই এ বিষয়টি খুব পরিষ্কারভাবে বুঝা প্রয়োজন। তাহলে হজ্বের প্রশিক্ষণের গুরুত্ব উপলব্ধি করা সহজ হবে এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণের আগ্রহ জন্মাবেঃ-
১। ‘হজ্ব’ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যময় ও বরকতের ইবাদাত। হজ্ব একটি আরবী শব্দ-এর আভিধানিক অর্থ হলো কোনো মহৎ কাজের জন্য দৃঢ় সংকল্প করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় হজ্ব হচ্ছে:-
ক। পবিত্র কা’বা শরীফ এবং মক্কা শরীফের সন্নিকটে মীনা, মুযদালিফা ও আরাফার ময়দানে হজ্বের মাসে নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট স্থানে কা’বা পরিদর্শনসহ কতগুলো ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাত আ’মল, সুন্নাত তরীকায় এবং ধারাবাহিকভাবে সুসম্পন্ন করা।
খ। অন্যদিকে হজ্ব হচ্ছে- আল্লহকে মহব্বত করা এবং আল্লহর মহব্বত লাভ করা। হজ্বের দাবী ও পাওনা আল্লহর মহব্বত ছাড়া আর কিছু নয়। এর প্রত্যেকটি আ’মল মহব্বতের আ’মল, এর প্রত্যেকটি মন্জিল মহব্বতের মন্জিল। হজ্ব হলো প্রেমপূর্ণ ইবাদাত। এর সব রুকন ও আ’মল সম্পাদন করতে হয় প্রেমিক ও পাগলের মতো।
গ। অন্যদৃষ্টিতে নিয়ম-নীতিতে ভরা এক বড় মাপের ইবাদাতের নাম ‘হজ্ব’। প্রত্যেকটি নিয়ম মহান আল্লহ ও তাঁর রসূল (সঃ) কর্তৃক নির্ধারিত। সুতরাং নিয়ম মানলেই সফলতা, আর নিয়ম না মানলেই ব্যর্থতা। যে হাজী যত সুন্দরভাবে নিয়ম অনুযায়ী হজ্বের কার্যাদি সম্পন্ন করে, সে ততটা সফল। সুতরাং হজ্বের নিয়ম-নীতি অর্থাৎ মাসআ’লা-মাসায়েল জানা ও মানা অপরিহার্য।
ঘ। সংক্ষেপে বলতে গেলে শরীয়তের পরিভাষায় হজ্ব হচ্ছে ঃ-
(১) ৮ যিলহজ্ব ইহ্রাম বেঁধে সূর্যোদয়ের পরে নিজ বাড়ি/হোটেল থেকে মীনার উদ্দেশে রওয়ানা দিয়ে মীনার তাঁবুতে পৌঁছে অবস্থান করা এবং ৫ ওয়াক্ত নামায আদায় করা।
(২) ৯ যিলহজ্ব ফজরের নামাজ মীনার তাঁবুতে আদায় করে সূর্যোদয়ের পরে আরাফাতে গমন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করা। এটি হজ্বের প্রধান ফরজ আ’মল।
(৩) ঐ দিনই সূর্যাস্তের পর মাগরিবের নামাজ আদায় না করে মুযদালিফার পথে রওয়ানা হওয়া, সেখানে পৌঁছে ইশার ওয়াক্ত হলে মাগরিব ও ইশার নামাজ একত্রে আদায় করা, অতঃপর সেখানে খোলা আকাশের নিচে রাত্রি যাপন করা।
(৪) ১০ যিলহজ্ব ফজরের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পর পূর্বাকাশ ভালোভাবে ফর্সা হলে মীনার উদ্দেশ্যে মুযদালিফা ত্যাগ করা।
(৫) ১০ যিলহজ্ব দ্বিপ্রহরের পূর্বেই বড় জামারায় ৭টি পাথর নিক্ষেপ করা, অতঃপর কুরবানি দিয়ে মাথা মুন্ডন করে ইহরাম মুক্ত হওয়া। একই দিনে মক্কা শরীফে গিয়ে ফরজ তওয়াফ ও ওয়াজিব সায়ী সম্পন্ন করে মীনায় ফেরত আসা।
(৬) ১১, ১২/১৩ যিলহজ্ব মীনায় অবস্থান করে সূর্য হেলার পর ৩টি জামারায় ৪২/৬৩টি পাথর নিক্ষেপ করে মক্কায় ফিরে এসে হজ্বের সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা।
ঙ। অন্যদৃষ্টিকোণ থেকে হজ্ব হচ্ছে ঃ-
(১) সকল দেশের, সকল বর্ণের, সকল ভাষার, ছোট-বড়, ধনী-গরীব সকল শ্রেণীর মুসলমানদের অর্থাৎ মুসলিম উম্মাহ্র এক মহামিলন।
(২) হজ্ব-সাম্যের প্রতীক। এক পোশাক, এক ধ্বনি, সকলের মুখেই উচ্চারিত হয়-- ‘লাব্বাইক আল্লহুম্মা লাব্বাইক.........’। ‘আমি হাজির, আল্লহ আমি হাজির........’। এটার নাম হজ্ব।
(৩) আরব-অনারব, সারা বিশ্বের সকল মুসলমানের একই লক্ষ্য, একই উদ্দেশ্য অর্থাৎ আল্লহর সান্নিধ্য, আল্লহর সাক্ষাত লাভ করাই হজ্ব।
(৪) সকলে মিলে আরাফার ময়দানে আল্লহর নিকট আত্মসমর্পণ ও আত্মোৎসর্গ করাই হজ্ব।
(৫) সর্বোপরি আল্লহর নিকট থেকে ক্ষমা প্রাপ্তি এবং জান্নাত লাভ করাই হজ্ব।
চ। মাবরুর হজ্ব - (যে হজ্ব আল্লহর দরবারে কবুল হয়)। যে হজ্ব পালনকালে কোনো ধরণের গুনাহের কাজে শামীল হয়নি, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও প্রদর্শনীর মনোভাবসহ আল্লহর নিষিদ্ধ কাজসমূহ পরিহার করে চলা হয়েছে এবং হজ্ব পরবর্তী বাকি জীবনে আল্লহর নির্দেশ পালনের দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে - সে হজ্বকেই মাবরুর হজ্ব বা হজ্জ্বে মাবরুর বলে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে সূরা:বাকারার ১৯৭নং আয়াতে আল্লহ্ বলেন, ‘হজ্বের মাস সমূহ (সুপরিচিত ও) সুনির্দিষ্ট, এ মাসগুলোর মধ্যে যে ব্যক্তি হজ্ব (আদায়) করার নিয়ত করবে (এ জন্যে ইহরাম বাঁধবে, সে যেন জেনে রাখে), হজ্বের ভেতর (কোনো) যৌনসম্ভোগ নেই, নেই কোনো অশ্লীল গালিগালাজ ও ঝগড়াঝাটি, আর যতো ভালকাজ তোমরা আদায় করো আল্লহ্ তা’আলা (অবশ্যই) তা জানেন। (হজ্বের নিয়ত করলে) এর জন্য তোমরা পাথেয় যোগাড় করে নেবে, যদিও তাকওয়াই (খোদা ভীতি/আল্লহ্ সচেতনতা), অতএব, হে বুদ্ধিমান মানুষেরা, তোমরা আমাকেই ভয় করো এবং আমার নাফরমানী হতে বিরত থাক।’
আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আল্লহর রসূল (সঃ) কে প্রশ্ন করা হল, ‘সর্বোত্তম আ’মল কোনটি ? তিনি জবাব দেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উপর ঈমান আনা।’ এরপর কোনটি ? তিনি জবাব দেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদ করা।’ এরপর কোনটি ? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হজ্জ্বে মাবরুর।’ (সহীহ্ বুখারী:১৪২০)
আশা করি মাবরুর হজ্ব সম্মন্ধে আপনাদের ধারণা পরিষ্কার হয়েছে।
২। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর আমল থেকে হজ্বের সূচনা হয়েছিল। আল্লহ তাআ’লা সর্বপ্রথম হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর মাধ্যমে মানব জাতিকে হজ্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন (সূরাঃ হাজ্ব-আয়াত নং ২৭, সূরাঃ বাকারাআয়াত নং ১৯৬, সূরাঃ আলে-ইমরান আয়াত নং ৯৭ দ্রষ্টব্য)। (রেফারেন্স)
৩। সংশ্লিষ্ট কুরআনের আয়াত এবং হাদীসের আলোকে শারীরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান প্রাপ্তবয়স্ক একজন মুসলিম নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ্বব্রত পালন করা ফরজ এবং একবার উমরাহ্ পালন করা সুন্নাতে মুয়াক্বাদা। একাধিকবার উমরাহ্ ও হজ্ব পালন করা নফল ইবাদাত হিসেবে গণ্য।
৪। আল্লহর মেহমানঃ আল্লহর মেহমান নির্বাচিত হওয়া এক মহা সৌভাগ্যের ব্যাপার। একজন অতি সাধারণ মানুষও আল্লহর মেহমান হয়ে যখন হজ্ব করেন তখন তিনি মহা সম্মানিত হয়ে যান। হজ্ব তাঁর সম্মান ও মর্যাদাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেয়। হজ্ব করে একজন মানুষ পরিবারে/সমাজে সম্মানের অতি উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়। সত্যিকার অর্থে আল্লহর মেহমান হওয়া এক অসাধারণ ব্যাপার। প্রকৃতপক্ষে একজন হজ্ব প্রার্থী বিশ্ব জগতের মালিকের মেহমান, সে কা’বার মেহমান, সে সোনার মদীনার মেহমান, তাইতো সে এতো মর্যাদাবান।
৫। দেশের একজন অতি সাধারণ নাগরিক যদি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর মেহমান হয়ে বঙ্গ ভবনে বা গণ ভবনে গিয়ে তাঁদের সাথে সাক্ষাত করার সুযোগ পায় তখন তার অবস্থা কি হয় ? সে তখন রাষ্ট্রীয় ভবনে উপস্থিত হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। জানার জন্য কত জনকে কতকিছু জিজ্ঞেস করে, কত রকম প্রস্তুতি নিতে থাকে। সুতরাং কোনো ব্যক্তি আল্লহর মেহমান হয়ে আল্লহর ঘরে (কা’বা শরীফে) উপস্থিত হয়ে আল্লহর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য কত ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার ? তাছাড়া একই সফরে সোনার মদীনায় গিয়ে মাসজিদুন নববী যিয়ারত করা এবং নবীজির রওজা পাকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সরাসরি তাঁর সমীপে সালাম ও দরূদ পেশ করার সুযোগ পাওয়াও কি কম সৌভাগ্যের কথা?