হজ্ব একটি কষ্টসাধ্য ইবাদাত
হজ্ব একটি কষ্টসাধ্য ইবাদাতঃ
সঠিক ও সুচারুরূপে হজ্ব পালন করা নিঃসন্দেহে একটি কষ্টসাধ্য ইবাদাত। এ কথায় ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এ কথার অর্থ- নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। অতীতকালে হজ্ব করতে যে ধরণের কষ্ট হতো, সেই কষ্টের কথা এখন কল্পনাও করা যায় না। বর্তমান সময়ে কষ্টের কারণ ও ধরণ সম্পূর্ণ অন্যরকম। সব ধরণের কষ্টের বিবরণ ও কারণ এ পোস্টে লেখা সম্ভব নয়, তবে প্রধান প্রধান কারণগুলো সম্বন্ধে কিছু ধারণা দেয়া হলোঃ-
ক। অতীতকালে কষ্টের কারণঃ পৃথিবীতে কা’বা শরীফ স্থাপনের পর থেকে অর্থাৎ আদম (আঃ) এর যুগ থেকেই কা’বা ঘর তওয়াফের সূচনা হয় এবং ইবরাহীম (আঃ) এর যুগ থেকে প্রকৃত হজ্বের প্রবর্তণ হয়। তখন মক্কা শরীফের অবস্থান, তওয়াফের এবং সায়ী করার স্থান, মীনা, আরাফাহ্ ও মুযদালিফার পরিবেশ, সেখানে পৌঁছার পথ-ঘাট, থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি অত্যন্ত কঠিন/দুর্গম/পীড়াদায়ক ছিল। সেজন্য পুরানো দিনে দূর-দূরান্ত থেকে যখন হাজী সাহেবরা হজ্ব করতে যেতেন, তখন তাঁরা নিজ নিজ আত্মীয় স্বজন, মহল্লা/গ্রামবাসীদের নিকট থেকে চিরবিদায় নিয়ে যেতেন। তখন মানুষ পদব্রজে, পশুর পিঠে, সমুদ্র পথে যাত্রা করে, ক্ষেত্র বিশেষে ২/৩/৪/৫/৬ মাসে মক্কায় পৌঁছতেন। এক কথায় তখন হজ্ব পালন করতে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হতো, যা বর্তমানে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। সম্ভব হলে পুরানো দিনের ছবি / ভিডিও দেখে নিবেন বা সে যুগের হজ্ব পালনের বর্ণনাসহ বই পড়বেন, তাহলে পূর্বের কষ্টের কথা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারবেন। এ ব্যাপারে মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদীর লেখা ‘সফরে হিজায’ পড়বেন।
খ। বর্তমানকালের কষ্টের কারণসমূহঃ যুগের বিবর্তনে বর্তমানে পূর্বের কষ্টের কারণগুলো আর এখন বিদ্যমান নেই। বর্তমানে যাতায়াত ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে। বর্তমানে মাসজিদুল হারাম ও মাসজিদুন নববী, এমনকি সাফা-মারওয়াতে সায়ী করার স্থানটুকুও সম্পূর্ণভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। মীনা/আরাফার তাঁবুগুলো পর্যন্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। মক্কা ও মদীনায় ফাইভ স্টার ও অন্যান্য উন্নত মানের হোটেলের/বাসস্থানের ছড়াছড়ি। পৃথিবীর সকল দেশের সকল প্রকার খাদ্য দ্রব্যের কোনো অভাব নেই। কিন্তু তারপরেও বিভিন্ন কারণে হজ্ব করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ গুলো খুব সংক্ষেপে
নিম্নে বর্ণনা করা হলোঃ
(১) হজ্বের কার্যক্রম সম্বন্ধে হাজীদের অজ্ঞতাঃ অজ্ঞতার কারণে বহু সংখ্যক হাজী সাহেব কিছু কিছু ভুল আ’মল করেন। ফলে অগণিত হাজীদের দুর্ভোগের/কষ্টের কারণ হয়। যেমন, অতি আবেগে হাজরে আস্ওয়াদকে চুম্বন করার জন্য চরম ঠেলাঠেলি/পুরুষ-মহিলাদের ধাক্কা-ধাক্কি, মাকামে ইব্রাহীমের পেছনে অর্থাৎ অতি সন্নিকটে নামাজে দাঁড়িয়ে যাওয়া, তওয়াফ শেষ করে বের হওয়ার সময় উল্টোদিক থেকে বের হওয়া, তওয়াফের স্থানে যেখানে সেখানে নামাজে দাঁড়িয়ে যাওয়া, পাথর মারার সময় উল্টোপথে চলার চেষ্টা করা, ইত্যাদি কারণে হাজীদের চরম কষ্ট হয়ে থাকে।
(২) মানুষের এবং গাড়ীর অবর্ণনীয় ভিড়-যানজট ও মানুষের জটঃ
কা’বা শরীফের চারদিকে তওয়াফ করার চত্বরে (মাতাফে), মাসজিদুল হারামের ভেতরে ও বাইরের চারদিকের চত্বরে, সাফা-মারওয়া সায়ী করার স্থানে, মীনার ময়দানে, আরাফাতের মাঠে, মুযদালিফায় অর্থাৎ সকল স্থানেই যে পরিমাণ লোক ধারণ করার বা চলাচলের অবস্থা বা ব্যবস্থা আছে- হাজীদের এবং সেবা দানকারী অন্যান্য লোকদের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশী হওয়ার কারণে অর্থাৎ অত্যধিক ভিড়ের কারণে হাজীদের দুর্ভোগ হয়ে থাকে। তাছাড়া হজ্বের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাত আমলগুলো সকল হাজীদেরকে প্রায় একই তারিখে, একই সময়ে এবং একই স্থানে সম্পন্ন করতে হয়, ফলে অতি ভিড়ের কারণে কষ্ট হয়। কা’বা শরীফে ওয়াক্তের নামাজ পড়তে যাওয়া-আসার সময়ও অতি ভিড়ের কারণে বয়স্ক পুরুষ-মহিলাদের অনেক কষ্ট হয়।
(৩) মানুষ ও গাড়ীর তুলনায় স্থানের ও রাস্তা-ঘাটের অপ্রতুলতাঃ
মক্কা, মীনা, আরাফাহ ও মুযদালিফায় যাতায়াতের জন্য সৌদী সরকার যদিও প্রতিনিয়ত রাস্তা-ঘাটের, সুড়ঙ্গ পথের এবং ওভার ব্রীজের উন্নতি সাধন করছেন, তবুও যেন মানুষের ও গাড়ীর স্থান সংকুলান হচ্ছে না। হজ্বের কার্যক্রমগুলো পালনের জন্য ৩০-৩৫ লক্ষ হাজীদেরকে হাজার হাজার গাড়ীতে এবং পায়ে হেঁটে মক্কা থেকে মীনা, মীনা থেকে আরাফাহ, আরাফাহ থেকে মুযদালিফা, মুযদালিফা থেকে মীনা, মীনা থেকে মক্কা একই দিনে এবং প্রায় একই সময়ে যাতায়াত করতে হয়, ফলে প্রচুর যানজট ও জনজটের সৃষ্টি হয়। ফলে এক ঘন্টার পথ অতিক্রম করতে অনেক বেশী সময় লেগে যায়। এছাড়া গাড়ী বিকল হওয়া, দুর্ঘটনা ঘটা ইত্যাদি অঘটনতো আছেই। তাই শান্তিপূর্ণ ও সহজভাবে হজ্ব পালন করার জন্য সর্বদা পরম করুণাময় আল্লহর নিকট সাহায্য কামনা করতে হবে। সৌদী সরকার অবশ্য হাজীদের কষ্ট লাঘবের জন্য সদা সর্বদা নিত্য নতুন পন্থা উদ্ভাবন করছেন, যেমন- তওয়াফ, সায়ী এবং রমী করার স্থানের উন্নতি সাধন এবং মক্কা-মীনা-আরাফা-মুযদালিফাতে চলাচলের সুবিধার জন্য মেট্রো ট্রেনের ব্যবস্থা ইত্যাদি। মক্কা-মদীনার মধ্যেও ট্রেন চলাচলের জন্য ট্রেন-লাইন বসানো হচ্ছে।
(৪) এতোসব আয়োজন/ব্যবস্থা করা সত্তেও কষ্টের শেষ নেই। সুতরাং হজ্বের সফরে যে কোনো কষ্ট ভোগের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। আর সদা সর্বদা আল্লহর সাহায্য কামনা করতে হবে।